Tuesday, November 6, 2012

অধ্যাপক আনু আহমেদ এর একটি চমৎকার লেখা


আতঙ্কের সমাজ, দখলদার অর্থনীতি,
জমিদারি রাজনীতি এটাই বর্তমান
সময়ের প্রধান পরিচয়এর মধ্যেই
আমরা আছি
বর্তমানে সারা দেশে দুর্নীতি দখলদারি,
নানা অগণতান্ত্রিক আইনি-
বেআইনি তৎপরতা, সন্ত্রাস-টেন্ডা
রবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য
ইত্যাদি বিস্তারের সুবিধাভোগী খুবই
নগণ্যযদি সামনে বিএনপি-জামায়াত
বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়
না থাকত
তাহলে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট
দিয়েছে তাদের ক্ষোভেইসরকার
টালমাটাল হতোআওয়ামী লীগসরকারের
জন্য এটাই আত্মরক্ষার প্রধান
অবলম্বনক্ষুব্ধ সমর্থকদের
ধরে রাখায় বিএনপি-জামায়াতের ভয়,
যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব তাদের প্রধান
ভরসাবিএনপি-জামায়াতও এই অস্ত্রই
বরাবর কাজে লাগিয়েছে
আওয়ামী আমলের ভীতি প্রচার, কৃত্রিম
ভারত-বিরোধিতা, ইসলাম ধর্ম
বিপন্নতার প্রচারণা তাদের অনেক
অপকর্ম জায়েজ করার প্রধান
অবলম্বনযারা এখন আওয়ামী লীগ
বা বিএনপির পেছনে আছে তাদের
অধিকাংশ অপছন্দ নিয়েই আছে,
আছে অন্য দলের ভয়েঅতএব
জমিদারি রাজনীতির দুই ধারা পরস্পর
পরস্পরের ভরসা, পরস্পর
পরস্পরেরজন্য অপরিহার্যঐক্য ও
ধারাবাহিকতারও তাই কমতি নেই
যে কেউ সরকারের
বা কোনো প্রতিষ্ঠানের
কর্তাব্যক্তিদেরঅন্যায় নিপীড়ন
বা দুর্নীতির
বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সরকারি দল
বা কর্তাব্যক্তিদের একটা মোক্ষম ঢাল
হলো এটা বলা যে, এটা যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের বিরুদ্ধে চক্রান্তশিক্ষক,
তৈরি পোশাক শ্রমিক, জমি সম্পদ
রক্ষার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের
শিক্ষা আন্দোলনসবাইকে এই
গালি শুনতে হয়কিন্তু
রামদা হাতে সরকারি পান্ডা, নিয়োগ-
বাণিজ্যে নিয়োজিত এমপি, গুম
খুনে সক্রিয় নানা বাহিনী,
সরকারি হামলা নির্যাতন দখল, আর
অদক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া থাকতে কি আর
কারও চক্রান্ত করার দরকার হবে?
৪০ বছর ধরে একাত্তরের দুর্বৃত্তদের
বিচার আটকে আছেজনগণের একটি বড়
অংশ তারেক জিয়ার জমিদারি তাণ্ডব
থেকে বাঁচার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের আশায় আওয়ামী লীগকে ভোট
দিয়েছিলসরকারের
ভূমিকা থেকে মনে হয় এই সরকার তারেক
জিয়াকে মহানায়ক না বানিয়ে,
যুদ্ধাপরাধীদের হাতে আত্মরক্ষার
আরও পুঁজি সরবরাহ নাকরে ভুল নীতি,
দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দখলদারির
যথেচ্ছাচার থেকে সরবে না
দম দেওয়া পুতুলের
মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন
পরিস্থিতি, কাল বা প্রশ্ন কোনো কিছুই
তাঁর গৎবাধা কথা বদলাতে পারে না
একের পর এক খুনি ধরাছোঁয়ার
বাইরে থাকে, খুনি ক্ষমা পায়, তিনি সব
সময় বলতে থাকেন অপরাধী যেই হোক
তাকে অবশ্যই ধরা হবেগুম খুন হাজার
ছাড়িয়ে যায়; তিনি বলেন, ‘দেশের
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো
ক্রসফায়ারে মৃত্যু হতে থাকে
রামদা হাতে সরকারি সংগঠনের
কর্মীরা নানা জায়গায় সন্ত্রাস
তৈরি করে, দখল চলে
আইনমন্ত্রী গড়গড় করে বলতেই
থাকেন, ‘আইন সবার জন্য সমান
চাঁদাবাজি শুধু উর্দিছাড়া নয়,
উর্দিপরা লোকজনও করতে থাকে
আইন-আদালত কী করে,
তা নিয়ে তো কথাবলাই নিষেধ
প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব
সমস্যা সমাধানে নিজেই দায়িত্ব নেন
কিন্তু কোনো সমাধান দেখা যায় না
দিনবদলের কথা অর্থহীন
যাদের ২৪ ঘণ্টা রাষ্ট্রীয়
অর্থেপ্রতিপালিত নানা বাহিনীর
পাহারায় কাটে তারা ছাড়া বাকি কারও
তাই আতঙ্ক কাটে নানিজের
ওস্বজনের জীবন নিয়ে, পথের
নিরাপত্তা নিয়ে, জিনিসপত্রের দাম,
জীবিকা, ভবিষ্যৎ
নিয়ে উৎকণ্ঠা দিনরাতসবচেয়ে বড়
ভয়, দিনের পর দিন
সবকিছুতে অনিশ্চয়তাবাংলাদেশের
মানুষের অবস্থা এখন এমনই যে মানুষের
জন্য মানুষের শোক, আতঙ্ক
কিংবা উদ্বেগ নিয়েও একটু স্থির
হয়ে বসা যায় নানতুন আরেকআঘাত
পুরোনো শোক
বা আতঙ্ককে ছাড়িয়ে যায়
টিভি বা সংবাদপত্রেরও ঠাঁই নেই
সবগুলোকে জায়গা দেওয়ার,
কিংবা লেগে থাকার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই
দলের সংঘাত কখনোই
জমিদারি লড়াইয়ের চরিত্র থেকে বের
হতে পারেনিযে অংশ ক্ষমতায়
থাকে তাদের ইচ্ছা হয়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ারতাই
একপর্যায়ে বিরোধ চরমে ওঠেতখন
মাঝেমধ্যে সম্রাটের দূতের
মতো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ
এমনকি ভারতের প্রতিনিধিদের
সাড়ম্বর আগমন ঘটেসংঘাতে তাদের
কর্তৃত্ব বাড়েদুই পক্ষ
প্রতিযোগিতা করে প্রভুরজন্য আরও
বাড়তি সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার
করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত
করতে চেষ্টা করেআফ্রিকার
দেশগুলোর মতো এ দেশে গোত্র
বা এথনিক সংঘাতের অবস্থা নেই
কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি লড়াই যেন
তার স্থানই পূরণ করতে যাচ্ছে,
রাজনৈতিক সংঘাত নিতে যাচ্ছে ট্রাইবাল
সংঘাতের রূপসারা দেশ, সব
প্রতিষ্ঠান এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে
যারা লাভবান হচ্ছে তারা তালিও
দিয়ে যাচ্ছেপ্রকাশ্যে বা গোপনে
দুই দলের ব্যানার দেখে পুরো চিত্র
পাওয়া যাবে নাদেখতে হবে ব্যানারের
পেছনে দাঁড়ানো দখলদার
কমিশনভোগীদেরদলের ব্যানার
আসলে ব্যবহূত হয় তাদের মুখ ঢাকার
জন্যমানুষ দল দিয়ে বিচার করে, দলের
ওপর ভরসা করে, দলের ওপর বিরক্ত
হয়, ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার
করেদল আসে যায়কিন্তু
কমিশনভোগী, দখলদারদের পরিবর্তন
হয় নাতাদের শক্তি ও অবস্থান আরও
জোরদার হয়দুই দলের তীব্র সংঘাত
চোখে পড়ে, আড়ালে দখল লুণ্ঠন
কমিশনসহ নানা তৎপরতায়
অংশীদারি ঠিকই চলে বহাল তবিয়তে
ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মুদ্রা পাচার,
মিডিয়াসহ নানা জায়গায় তার স্বাক্ষর
আছে
সে জন্য গুম, খুন, ক্রসফায়ার,
উর্দিপরা বা উর্দিছাড়া লোকজনদের
ডাকাতি চাঁদাবাজি, কৃত্রিম
কিংবা উসকে তোলা রাজনৈতিক
উত্তেজনা, হরতাল, বিদ্যুতের সংকট
সবকিছু নিয়ে মানুষের অস্থিরতা,
উদ্বেগ, অসুস্থতার মধ্যে ঠিকই অনেক
কিছুহয়ে যেতে থাকেশতকরা এক ভাগের
হাতে আরও সম্পদ কেন্দ্রীভূত
হতেকোনো বাধা নেইপাহাড় নদী বন
দখলকাজে কোনো সমস্যা নেই
দেশেরসমুদ্র, সম্পদ, অর্থনীতিতে দেশি-
বিদেশি লুটেরাদের আধিপত্যবৃদ্ধির
আয়োজনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই
এগুলোতে দুপক্ষের বিরোধ নেই
এখানে দুই বন্ধু (বা শত্রুর) গল্প বলি
এরা হতে পারে দুজন আমলা, দুজন
ঠিকাদার, দুজন কনসালট্যান্ট, দুজন
মন্ত্রী এমনকি হতে পারে দুই সময়ের দুই
সরকারগল্পের শুরুর কালে বন্ধু
’-এর সীমিত আয়, স্বাভাবিক
জীবনযাপনএর মধ্যে একদিন ’ ‘’-
এর বাড়িতে গিয়ে হতবাক
ঘরবাড়িতে নতুন বিত্তের চিহ্ন
কোথায় পেলে তুমি এসব?’ বারবার
প্রশ্ন করায় একপর্যায়ে ’ ‘
কে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বলে
বাইরে একটা সড়ক ছাড়া আর কিছু নেই
বলে এটাইদিন মাস বছর যায়
যায় ’-এর বাড়িতে’-এর বাড়ির
জাকজমক তার চেয়েও বেশি
কীভাবে এত টাকা বানানো সম্ভব?’ ‘
এবার হাসিমুখে ’-
কে জানালা দিয়ে তাকাতে বলে
একটা সেতু, দুপাশে ভাঙা,
আধাখেচড়া পড়ে আছেবুঝতে পারে
আবার দিন মাস বছরযায়যায় ’-
এর বাড়িতে, এখন সেটা অট্টালিকা
বিত্তের আওয়াজ বেড়েছে অনেক গুণ
’-এর মাথায় প্রশ্নএত
টাকা কীভাবে সম্ভব?’‘আবার
জানালা দিয়ে তাকাতে বলে
বাইরে কোনো কিছু নেইশুধু মাঠ
প্রথমে বুঝতে পারে নাবলে, ‘এই
তোপ্রথমে কাজ করে লাভ, পরে কিছু
কাজ করে পুরো টাকাপরে কিছুই
না করে পুরোটাই মেরে দেওয়া
সেটাই তো হওয়ার কথা
প্রক্রিয়া যদি একই থাকে ক্ষুধা দিন
দিন বাড়তে থাকেপেট তো ভরতে হবে
তাই এভাবে চলতে চলতে মাঠ, গাছ, বন,
জঙ্গল, পাহাড়, নদী, নালা, খালবিল সব
হজম হতে থাকেআর ’-এর যখন
যার সুযোগ আসে
কখনো প্রতিযোগিতা কখনো সহযোগিতা
কখনো ঐক্য কখনো সংঘাতদখল,
কমিশনের ওপর দাঁড়ানো বিত্ত-বৈভব
শানশওকতে শহরের কিছু কিছু স্থান
ঝলমল করতে থাকেঅনেকে স্মরণ
করতে পারেন সেলিম আল দীনের
মুনতাসির ফ্যান্টাসি নাটকসবকিছুই
প্রধান চরিত্র মুনতাসিরের খাদ্যতার
ক্ষুধার কোনো শেষ নেইআমাদের
দেশে একের পর এক
শাসকগোষ্ঠী একজনের থেকে অন্যজন
আরও বেশি মুনতাসির
ক্ষমতাবানেরা যখন এভাবে নিজের
অর্থনীতি তৈরি করেন তখন
রাজনীতিকেন
জমিদারি থেকে আলাদা হবে? আমাদেরই
বা সদা আতঙ্ক ছাড়া আর কীপাওয়ার
আছে?
দেশি-বিদেশি দখলদারদের জন্য দুই দলের
পালাবদল খুবই সুবিধাজনকএই নিয়েই
বেঁচে থাকতে হবে, সমাজে এই
চিন্তা টিকিয়ে রাখতে কারও কারও
সক্রিয়তা আছেএই অবস্থায়
তাহলেকী হবে বাংলাদেশের?
পরিবারতন্ত্রের আড়ালে, চোরাই টাকার
মালিক সন্ত্রাসী প্রতারক দখলদার
কমিশনভোগীদের হাতে, নিজেদের
সর্বনাশ দেখতেই থাকবে শতকরা ৯৯
ভাগ মানুষ? তাহলে কি আরউপায় নেই?
শক্তিশালী মিডিয়া ও সুশীল সমাজের
দরবারে এই বলয়ের বাইরে আলোচনারও
সুযোগ কমভিন্নস্বর ভিন্ন সত্য
ভিন্ন সম্ভাবনানিয়ে মানুষের চিন্তার
সুযোগও তাই তৈরি হয় না
ফলে জনগণের মধ্যে এক অসহায়ত্বের
বোধ এখন প্রায় স্থায়ীরূপ নিয়েছে
কিন্তু এই দুই ধারার একটির
বদলে অন্যটি আমাদের বর্তমান
অবস্থার যে কোনো সমাধানই
দেবে না তা বোঝার জন্য আর কত
পালাবদল দরকার? আর কত ক্ষয় আর
কত সর্বনাশদেখতে হবে আমাদের? এই
জমিদারি সংঘাত ও ঐক্য কোথায়
নিয়ে যাবে দেশকে, ক্ষমতা তাদেরও
হাতে থাকবে কি না, দেশি-
বিদেশি কারা অপেক্ষমাণসবকিছুই
এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তাএই বিষচক্র
থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ
সামরিক শাসন যে সমাধান নয় তার
প্রমাণ বারবার হয়েছেবরং এতে এই
প্রক্রিয়ারই আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে
আর দুজনের সংলাপ ও ঐক্য? তাতে এই
ধারাবাহিকতা ও জনগণের অবস্থার
পরিবর্তনের তো কিছু নেই
সে কারণেই যুদ্ধাপরাধী ও লুটেরাশক্তির,
দখলদার ও জমিদারদের রাজনৈতিক
মতাদর্শিক প্রভাব অতিক্রম
করে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির
বিকাশ ছাড়া উপায় দেখি নানিষ্ক্রিয়,
আচ্ছন্ন আর সন্ত্রস্ত জনগণের
মধ্যে ক্ষমতার বোধ বিকশিত
হওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়
দখলদারদের দাপটে বাংলাদেশ
নিয়ে স্বপ্ন দেখাই এখনঅসম্ভব
মনে হতে পারেকিন্তু বর্তমান
ক্ষমতার জালের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত
হলে, নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সক্ষম
হলে, জনগণ তার অন্তর্গত বিশাল
শক্তিও অনুভব করতে সক্ষম হবে,
সক্ষম হবে স্বাধীন পথ গ্রহণকরতে
মানুষ যদি নিজে মুক্ত না হয়, তার
মুক্তির কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় না
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়


No comments:

Post a Comment